তুচ্ছ মানুষেরা এতই তুচ্ছ যে তাদের মৃত্যুকেও তুচ্ছ করে দেওয়া যায়। তুচ্ছ মানে ফালতু, সস্তা, খরচযোগ্য; এমনকি হত্যাযোগ্যও। তুচ্ছ মায়ের তুচ্ছ শিশু সামিউলের তুচ্ছ দেহে আঘাত করে করে তুচ্ছ প্রাণবায়ু বের করতেও ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। তুচ্ছ বাবার তুচ্ছ সন্তান কিশোর মিলনকে মারা হয় রাস্তায় ফেলে, লাঠি-বাঁশ দিয়ে পিটিয়ে। সামিউলকে চোর বলা হয়েছিল, আর মিলনকে ডাকাত। কে বলেছিল? পুলিশ। কে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিল? পুলিশ! কে গণপিটুনির আয়োজন করেছিল? পুলিশ। তারপর লাশ কে নিয়ে গিয়েছিল? পুলিশ! তারপর কে তার বাবাকে বেকার বানিয়ে, জমি থেকে উচ্ছেদের পরিস্থিতি তৈরি করে, পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে খুনিদের ‘নির্দোষ’ ঘোষণা করতে বাধ্য করেছিল? পুলিশ! সামিউলের খুনিকে পালাতে সাহায্য করেছিল কে? পুলিশ! তারপরও আমরা কার কাছে সাহায্য চাইতে যাব? পুলিশের কাছে! কারণ, তুচ্ছ মানুষের যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। কারণ, ইতিহাস ও শাসকেরা তুচ্ছ মানুষদের খুঁজে না পেলেও, পুলিশ ঠিকই তাদের খুঁজে বের করে আসামির শূন্যস্থান পূরণ করতে, ফাঁসাতে, হয়রানি ও নির্যাতন করতে পারে। তুচ্ছ মানুষের সন্তানেরাও বেঁচে থাকলে ভোগে, হত্যা হলে চোর-ডাকাতের খেতাব পায়।
চার বছর আগে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের কিশোর মিলনকে হত্যার ঘটনা ঘটে। পুলিশের গাড়িতে করে তুলে এনে উন্মত্ত জনতার সামনে ছেড়ে দেওয়া হয় ডাকাত বলে। এটা এমন এক সময়ের এমন এক এলাকার গল্প, যেখানে মানুষ ডাকাতের ভয়ে কাঁপত। এরই প্রতিক্রিয়ায় সেখানে দফায় দফায় গণপিটুনিতে ৫ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত ডাকাত হত্যা করা হয়েছিল। একসময় এটাই নিয়ম হয়ে যায়। ক্ষমতাবানেরা তাদের চক্ষুশূলদের ডাকাত অপবাদ দিয়ে হত্যার চল শুরু করে দেয়। পুলিশ কখনো এসব হত্যার হাতিয়ার, কখনোবা ম্যানেজার। কিশোর মিলন সে রকমই এক সাজানো ডাকাত। কারা সাজায়? এখানেও আসবে পুলিশ ও প্রশাসনের নাম, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রতাপশালীদের নাম। মিলন হত্যার আসামি পুলিশ ও ‘পাবলিক’কে বাঁচাতেও তাই দেখা যায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সরকারি কৌঁসুলির নাম। আর হত্যাকারী পুলিশেরা সগৌরবে চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশগিরি। বিচারহীনতার দেশে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, গণপিটুনি দুর্বলের বিরুদ্ধে সবলের ‘বিচার’। দুর্বলের স্বজনদের কাটা ঘায়ে বিচার না হওয়ার লবণ লাগে বারবার।
রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এ ধরনের মানুষকে বলা হতো ‘হোমো সাসের’। তারা স্বাধীন নাগরিকও ছিল না, আবার তাদের দাসও বলা যেত না। তাদের হত্যায় অপরাধ হতো না। আত্মপক্ষ সমর্থনের যোগ্যতা ছিল না তাদের। তাদের মৃত্যু কখনো পবিত্রতার মর্যাদা তথা শহীদি সম্মান পেত না। রোহিঙ্গাদের মতো, পোশাকশ্রমিকদের মতো বাংলাদেশে আজ নিচুতলার অনেক মানুষ ক্রমেই দুর্ভাগ্যের হোমো সাসের দশায় পতিত হচ্ছে।
‘আর সেই পুলিশ এমনই পুলিশ, আসামিকে কিচ্ছু বলে না, আমাদের ধরে নিয়ে যায়।’ উৎপল দত্তের বিখ্যাত টিনের তলোয়ার নাটকের সংলাপ। সেটা ব্রিটিশ আমলের কাহিনি। পুলিশ বস্তুটিও ব্রিটিশ শাসনেরই উপহার। ব্রিটিশের পরে পাকিস্তানি শাসক এসেছে, পোশাক বদলালেও পুলিশের খাসলত বদলায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে যেই রাজের কখনো পতন হয় না, তা হলো পুলিশরাজ। সেনাশাসকদের শাস্তি হয়, পুলিশ রাজের শাস্তি হয় না। পুলিশ অক্ষয়, অভ্রান্ত, অটুট। তারা সরকারের খুঁটি, অপরাধীদের জুটি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর লগ্নের বীরেরা তো ছিলেন রাজারবাগে অবস্থানকারী পুলিশরাই। পুলিশের এমন এক সিনিয়র সাব-ইন্সপেক্টরকে জানি, যিনি অপরিসীম নিষ্ঠায় বেশ কটি খুনের রহস্যের জট খুলে আসামিদের কাঠগড়া পর্যন্ত তুলেছিলেন। জঙ্গি বাংলা ভাইকে ধরার আয়োজনে যিনি ধুরন্ধর গোয়েন্দার ভূমিকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামগঞ্জ। যিনি অবসর নেওয়ার পরও নিজ এলাকার থানার টেবিলে গিয়ে বসে থাকেন, নিরীহ মানুষের মামলার এজাহার লিখে দেন।
‘অশুভ’র বাস আমাদেরই মধ্যে। আমরাই সুর ও অসুর। অসুরের হাত থেকে বাঁচতে এখন পুলিশ বাহিনীর সুর-মানুষদের জেগে ওঠার সময়। আর সেই জাগরণ তখনই অনিবার্য হবে, যখন এ ধরনের নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে, গণপিটুনির বিরুদ্ধে গণমানুষ একসঙ্গে বলে উঠবে, ‘আর না।’
মিলন থেকে সামিউল, নিষ্পাপের নৃশংস হত্যা, আর কখনোই না!
রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এ ধরনের মানুষকে বলা হতো ‘হোমো সাসের’। তারা স্বাধীন নাগরিকও ছিল না, আবার তাদের দাসও বলা যেত না। তাদের হত্যায় অপরাধ হতো না। আত্মপক্ষ সমর্থনের যোগ্যতা ছিল না তাদের। তাদের মৃত্যু কখনো পবিত্রতার মর্যাদা তথা শহীদি সম্মান পেত না। রোহিঙ্গাদের মতো, পোশাকশ্রমিকদের মতো বাংলাদেশে আজ নিচুতলার অনেক মানুষ ক্রমেই দুর্ভাগ্যের হোমো সাসের দশায় পতিত হচ্ছে।
‘আর সেই পুলিশ এমনই পুলিশ, আসামিকে কিচ্ছু বলে না, আমাদের ধরে নিয়ে যায়।’ উৎপল দত্তের বিখ্যাত টিনের তলোয়ার নাটকের সংলাপ। সেটা ব্রিটিশ আমলের কাহিনি। পুলিশ বস্তুটিও ব্রিটিশ শাসনেরই উপহার। ব্রিটিশের পরে পাকিস্তানি শাসক এসেছে, পোশাক বদলালেও পুলিশের খাসলত বদলায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে যেই রাজের কখনো পতন হয় না, তা হলো পুলিশরাজ। সেনাশাসকদের শাস্তি হয়, পুলিশ রাজের শাস্তি হয় না। পুলিশ অক্ষয়, অভ্রান্ত, অটুট। তারা সরকারের খুঁটি, অপরাধীদের জুটি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরুর লগ্নের বীরেরা তো ছিলেন রাজারবাগে অবস্থানকারী পুলিশরাই। পুলিশের এমন এক সিনিয়র সাব-ইন্সপেক্টরকে জানি, যিনি অপরিসীম নিষ্ঠায় বেশ কটি খুনের রহস্যের জট খুলে আসামিদের কাঠগড়া পর্যন্ত তুলেছিলেন। জঙ্গি বাংলা ভাইকে ধরার আয়োজনে যিনি ধুরন্ধর গোয়েন্দার ভূমিকায় ঘুরে বেড়িয়েছেন গ্রামগঞ্জ। যিনি অবসর নেওয়ার পরও নিজ এলাকার থানার টেবিলে গিয়ে বসে থাকেন, নিরীহ মানুষের মামলার এজাহার লিখে দেন।
‘অশুভ’র বাস আমাদেরই মধ্যে। আমরাই সুর ও অসুর। অসুরের হাত থেকে বাঁচতে এখন পুলিশ বাহিনীর সুর-মানুষদের জেগে ওঠার সময়। আর সেই জাগরণ তখনই অনিবার্য হবে, যখন এ ধরনের নৃশংস হত্যার বিরুদ্ধে, গণপিটুনির বিরুদ্ধে গণমানুষ একসঙ্গে বলে উঠবে, ‘আর না।’
মিলন থেকে সামিউল, নিষ্পাপের নৃশংস হত্যা, আর কখনোই না!
No comments:
Post a Comment